দেশে নিম্নমানের বিটুমিনের আমদানি ঠেকাতে খালাসের আগেই মান পরীক্ষার বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। এ সংক্রান্ত নীতিমালা সংশোধন করে গেজেট প্রকাশ করেছে বাণিজ্যমন্ত্রণালয়। এখন থেকে আমদানি করা বিটুমিন মান পরীক্ষা ছাড়া খালাস করা যাবে না।আদেশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট- বিএসটিআই, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েট ও ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড-ইআরএলের মাধ্যমে পণ্যের গুণগতমান পরীক্ষা করতে হবে।
রাষ্ট্রপতির আদেশক্রেমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ মনির হোসেন হাওলাদার স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়েছে, পরিশিষ্ট-১ এর নিয়ন্ত্রিত পণ্যের তালিকার ‘ক’ অংশের এইচএস হেডিং নম্বর ২৭.২৩ এর বিপরীতে কলাম ২ ও ৩ এ উল্লেখিত এন্ট্রিসমূহের নিম্নরূপ এইচএস হেডিং নম্বর এবং এন্ট্রিসমূহ প্রতিস্থাপিত হবে।আদেশে আরো বলা হয়েছে, ২৭.২৩ এর সকল এইচএস কোডে, পেট্রোলিয়াম কোক এবং প্রেট্রোলিয়াম বিটুমিন ব্যতিত পেট্রোলিয়াম তেলের রেসিডিউলসমূহসহ সকল পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ। তবে পেট্রোলিয়াম বিটুমিন আমদানির ক্ষেত্রে এইচএস কোড নম্বর ২৭১৩.২০.১০ এবং ২৭১৩.২০.৯০ এর পণ্য খালাসের পূর্বে ইহার গুণগত মান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট ( বিএসটিআই), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড হতে পরীক্ষা করাতে হবে।
সড়ক নির্মাণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বিটুমিন। চাহিদার তুলনায় দেশীয় উৎপাদন কম হওয়ায় এ উপাদানের ঘাটতি থেকে যায়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশে গড়ে উঠেছে আমদানিকারকদের একটি শক্তিশালী চক্র। অর্থপাচারের কৌশল জিইয়ে রাখতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বিটুমিন ব্যবহারের সরকারি নির্দেশনাকেও পাত্তা দিচ্ছে না সংঘবদ্ধ চক্রটি। ফলে আমদানি করা মানহীন ও ভেজাল বিটুমিন ব্যবহার একটুও কমেনি। বরং আমদানির আড়ালে বিগত ১০ বছরে দেশ থেকে অন্তত ১৪ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। ‘ওভার ইনভয়েসিং’ বা আমদানি মূল্য বেশি দেখিয়ে অর্থ পাচারের ফলে দেশ হারাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার বড় অংকের রিজার্ভ।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রতিবছর পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টন বিটুমিনের চাহিদা রয়েছে। যার বাজারমূল্য প্রায় ২৪ থেকে ২৬ হাজার কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড দেশে মাত্র ৬০ থেকে ৭০ হাজার টন বিটুমিন উৎপাদন করে যা চাহিদার মাত্র ১৩ শতাংশের মতো। অর্থাৎ বাকি অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকার বিটুমিনের প্রায় পুরোটাই আমদানি করা হয় বিদেশ থেকে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে তিন লাখ ১৯ হাজার ৬৬১ টন বিটুমিন আমদানি করেছে ৪২টি প্রতিষ্ঠান। ৩৪৬টি ভিন্ন ভিন্ন চালানে আনা এই বিটুমিনের ‘অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু’ ছিল প্রায় এক হাজার ১১০ কোটি টাকা। বাল্ক এবং ড্রামে আমদানি করা এসব বিটুমিন কাস্টমস থেকে খালাস করা হয় উন্নতমানের ৬০/৭০ গ্রেড ঘোষণা দিয়ে। কিন্তু এগুলোর মান নিয়ে তৈরি হয় সন্দেহ। প্রকৃতপক্ষে ৬০/৭০ গ্রেডের বিটুমিন দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করা হলে তা খুবই টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কথা, যা বাস্তবে দেখা যায় না। আর তাই সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে প্রশ্ন ওঠে এসব বিটুমিনের গুণগত মান নিয়ে।
বিটুমিন আমদানিকারকদের একটি অংশ এসব বিটুমিনকে উন্নত মানের ৬০/৭০ গ্রেডের বিটুমিন বললেও অনুসন্ধানে দেখা যায় ভিন্ন তথ্য। ল্যাবরেটরির পরীক্ষায় এসব বিটুমিনের কোনো কোনোটির গ্রেড পাওয়া গেছে ১০২, কোনোটির ৯৫, আবার কোনোটির ৯৮। বিটুমিন বিশেষজ্ঞরা এগুলোকে আলকাতরার চেয়েও নিম্নমানের বলে দাবি করছেন।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের দেওয়া তথ্য মতে, প্রতিবছর গড়ে চার লাখ ২০ হাজার টন বিটুমিন আমদানি করে প্রতিষ্ঠানগুলো। এ হিসাবে প্রকৃত মূল্যের বাইরে প্রতিবছর বিদেশে পাচার হচ্ছে অন্তত এক হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা ১০ বছরে দাঁড়ায় ১৪ হাজার ২৮০ কোটিতে।
ইস্টার্ন রিফাইনারির কর্মকর্তারা বলছেন, আমদানি করা বেশিরভাগ বিটুমিনই ৮০ থেকে ১০০ গ্রেডের। বিটুমিন আমদানির এলসি খুলে কার্যত আনা হয় ভেজাল কেরোসিন মেশানো আলকাতরা। কিন্তু আমদানিকারকরা ঠিকই উন্নত গ্রেড দেখিয়ে সমপরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করছেন।